কথিত আছে ফুটবলের দেশ ব্রাজিলের ফুটবল ক্লাবগুলো তাদের দেশের উঠতি খেলোয়াড়দের পরিপূর্ণ খেলোয়াড় হিসেবে গড়ে তুলে ইউরোপের ক্লাবগুলোর কাছে বেশি দামে বিক্রি করার উদ্দেশ্যে। নতুন খেলোয়াড় গড়ে বিদেশি ক্লাবের কাছে বিক্রি করাই তাদের আয়ের মূল উৎস। কিন্তু নেইমারের ক্ষেত্রে তেমনটি ঘটে নি। সে সময় নেইমার সবে মাত্র “সান্তোসের” জুনিয়র দলের সিড়ি বেয়ে পেশাদার লীগে পা রেখেছে। এমন সময় এক বিকেলে ইংল্যান্ডের ক্লাব ওয়েস্ট হ্যাম ইউনাইটেড এর এক স্কাউটের নজড় পড়ে নেইমারের দিকে। ওয়েস্ট হ্যাম ইউনাইটেড নেইমারকে কেনার জন্য ১২ মিলিয়ন পাউন্ডের অফার দেয়। এতো বড় অংকের অফার পাওয়া সত্ত্বেও সেসময় “সান্তোস” নেইমারকে বিক্রি করেনি। কেননা তারা নেইমারের মধ্যে এমন কিছু দেখেছিলেন যা এই প্রস্তাবের কাছে তুচ্ছ। বিশ্বফুটবলের মানচিত্রে এভাবেই পরিচিত হয়ে উঠলেন নেইমার দা সিলভা সান্তোস জুনিয়র, সংক্ষেপে নেইমার।
ইউরোপের ক্লাবগুলোর হুড়োহুড়ি
নেইমার তখনো ব্রাজিলের জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পায় নি। এরই মধ্যে ওয়েস্ট হ্যাম ইউনাইটেড বড় অংকের টাকা অফার করেও নেইমারকে দলে নিতে পারে নি। তাই বলে ইউরোপের অন্য ক্লাবগুলো বসে থাকে নি। এরপর ইউরোপের আরেক জায়ান্ট চেলসি নেইমারকে দলে নিতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। সান্তোস কর্তৃপক্ষকে সবসময় তটস্থ থাকতে হয়েছে নেইমারকে ইউরোপের ক্লাবগুলোর স্কাউটদের লোভনীয় ফাঁদ থেকে আগলে রাখতে।


ছোট্টবেলার নেইমার
যেভাবে লাইমলাইটে উঠে এলেন
সান্তোসের হয়ে প্রথম মৌসুমে খুব বেশি সফলতা অর্জন করতে পারেননি নেইমার। কেননা প্রথম দিকে নেইমারকে খেলানো হতো না। ২০০৯ সালের ১১ই এপ্রিল ব্রাজিলিয়ান কাপের শেষের দিকে সুযোগ পেয়ে সেমিফাইনালে পালমেইরাসের বিপক্ষে জয়সূচক গোল করেও সান্তোসকে ফাইনালে তুলতে পারেননি। পরের মৌসুমে সুযোগ পেয়েই ঝলসে উঠলেন। ২০১০ সালের ব্রাজিলিয়ান কাপের শিরোপার সাথে সাথে অর্জন করেন সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারও। এই লীগে নেইমার ১৯ খেলায় ১৪ গোল করেন। সে সময়ই চারিদিকে নেইমার নেইমার রব পড়ে যায়। নেইমারের নৈপুণ্যে সান্তোস ব্রাজিলিয়ান লিগ কাপ আর কোপা লিবার্তাদোরেসের ট্রেবল শিরোপা অর্জন করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ব্রাজিলিয়ানরা নেইমারকে পেলের উত্তরসূরি হিসেবে ভাবতে শুরু করে এবং ব্রাজিল জাতীয় দলের হয়ে খেলার সুযোগ হয় নেইমারের।


নেইমারের কিছু ভিডিও চিত্র
পেলে, ম্যারাডোনার মতো নেইমারের জীবনও দারিদ্রে ভরপুর
ফুটপাথ, সমুদ্র সৈকত কিংবা বস্তিতে খেলতে খেলতে বেড়ে ওঠা, এক সময় বিশ্বসেরা তারকা বনে যাওয়া। দক্ষিণ আমেরিকার সব ফুটবল গ্রেটের ক্ষেত্রেই এর যে কোন একটি প্রযোজ্য। নেইমার দ্য সিলভা সান্তোস জুনিয়রের উত্থানও অন্যসব ফুটবল গ্রেটের মতোই। দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ আর জীবিকার তাগিদে ফুটবলকে ধ্যান-জ্ঞান ও পেশা হিসেবে বেছে নেয়া।


পেলে-ম্যারাডোনার সান্নিধ্য ছোটবেলায়ই পেয়েছেন নেইমার
২০১২-১৩ মৌসুমে নেইমারের কিছু ক্রীড়াশৈলী
বাবার স্বপ্ন পূরণ করলেন ছেলে
নেইমারের বাবা ‘সিনিয়র নেইমার দ্যা সিলভা’র ইচ্ছে ছিল বড় মাপের ফুটবলার হয়ে ভাগ্যের চাকা ঘোরানোর। সেই লক্ষ্যে ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের মধ্যাঞ্চলের শহর সাও ভিনসেন্ট ছেড়ে সাও পাওলোর মগি দাস ক্রুজেস শহরে পাড়ি জমান। কিন্তু পেশাদার ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন অধরাই থেকে যায় সিনিয়র নেইমারের।
নিদারুণ ওই দুঃসময়ে সিনিয়র নেইমারের ভালবাসার প্রতীক হিসেবে ঘর আলো করে আসে ব্রাজিলের বস্তি থেকে ফুটবল বিশ্ব শাসন করতে আরও একজন বিস্ময়বালক। এরপর স্বপ্নের পরিধি বেড়ে যায় তার। নিজের অপূর্ণ ইচ্ছা ছেলেকে দিয়ে পূরণের স্বপ্ন দেখতে থাকেন। এ কারণে অভাবের সংসার হলেও ছেলেকে এর আঁচ লাগতে দেননি। সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন উত্তরসূরির চাওয়া পূরণ করতে। ছোট্ট ছেলের প্রতিভা ক্ষুরধার হওয়ায় কাজটাও সহজ হয়।

বাবা-মায়ের সাথে ছোট্ট নেইমার
শুরুটা সেই রাস্তার ফুটবল দিয়েই
সাও পাওলোর রাস্তায় ফুটবল খেলতে খেলতে ফুটবলের সঙ্গে প্র্রেম হয়ে যায় সেদিনের ছোট্ট নেইমারের। তবে নেইমারের বিস্ময়কর উত্থানের শুরু ২০০৩ সাল থেকে। ওই বছর তিনি কিশোর প্রতিভা হিসেবে কিংবদন্তি পেলের সাবেক ক্লাব সান্তোসে যোগ দেন।
ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট
ব্রাজিল জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার আগে থেকেই নেইমারের নাম ডাক থাকলেও কনফেডারেশন্স কাপ নেইমারের তারকখ্যাতি বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণে। ২১ বছর বয়সী এই প্রাণচঞ্চল তরুণ ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত নবম ফিফা কনফেডারেশন্স কাপে আরেকবার চিনিয়েছেন নিজের জাত। বিশ্বের বাঘা ফুটবলারদের পেছনে ফেলে আসরের সেরা খেলোয়াড়ও নির্বাচিত হন। এ আসরে নেইমার ৪ গোল করেন। নিজ দেশ ব্রাজিলকে ঐতিহাসিক হ্যাটট্রিক শিরোপা জয়ে কারিগরের ভূমিকা পালন করেন। ফুটবল বোদ্ধাদের মতো কনফেডারেশন্স কাপই নেইমারের ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট।
এর আগে অবশ্য ব্রাজিলের জার্সি গায়ে ২০১১ সালের কোপা আমেরিকা খেলেছিল নেইমার। আর্জেন্টিনায় অনুষ্ঠিত সেই টুর্নামেন্টে নেইমার ১ম রাউন্ডের ম্যাচে ইকুয়েডরের বিপক্ষে ২ গোল করে ম্যান অব দ্যা ম্যাচ নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেই টুর্নামেন্টে ব্রাজিল কোয়ার্টার ফাইনালে হেরে বাদ হয়ে যায়।
এরপর ২০১২ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে ব্রাজিল দলের সঙ্গী হন নেইমার। ১ম ওয়ার্ম আপ ম্যাচে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ব্রাজিল ২-০ গোলে জিতে, যার দুটি গোলেই ছিল নেইমারের অবদান। পুরো টুর্নামেন্টে নেইমার নিজে তিনটি গোল করেন এবং বেশ কিছু গোলে ভূমিকা রাখেন। এই টুর্নামেন্টে ব্রাজিল রৌপ্য পদক জয় করেন।


ব্রাজিলের হয়ে নেইমারের শীর্ষ ১০টি গোল
নেইমারের খেলার ধরন
হালকা পাতলা গড়নের এই ফুটবলারটি দুই পায়ের একজন পরিপূর্ণ ফুটবলার। আক্রমনভাগের এই ফুটবলারটি ছন্দময় ফুটবল খেলতে পছন্দ করেন। বল নিয়ে দ্রুত গতিতে প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগ তছনছ করতে নেইমার যথেষ্ট দক্ষ।
নেইম্যারাডোনা
আর্জেন্টাইনরা এই বিস্ময় প্রতিভার খেলার নিখুঁত কৌশল দেখে তাঁদের চোখে সর্বকালের সেরা ম্যারাডোনার সঙ্গে সাদৃশ্য রেখে নাম দিয়েছিলেন ‘নেইম্যারাডোনা।’ আর ব্রাজিলিয়ানরা ডাকতে শুরু করেছিলেন ‘নতুন পেলে’ নামে।
সান্তোস যুগের সমাপ্তি
পেলে একসময় নেইমারকে পরামর্শ দিয়েছিলেন সারা জীবন সান্তোসেই থেকে যাওয়ার জন্য। কিন্তু কে না জানে, পেশাদার ফুটবলের জগৎটা এমনই কঠিন যে এখানে খেলোয়াড়রা চাইলেও আসলে উপেক্ষা করতে পারে না অনেক কিছু। এরই ফলশ্রুতিতে সমেয়র সেরা এই স্ট্রাইকার গত ৩০ জুলাই, ২০১৩ ইং তারিখে পোল্যান্ডের ক্লাব লেসিয়া দানস্কের বিরুদ্ধে প্রীতি ম্যাচে বার্সেলোনার হয়ে মাঠে নামেন। ৫৭ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে ব্রাজিলিয়ান ক্লাব সান্তোস ছেড়ে স্প্যানিশ ক্লাব বার্সেলোনায় নাম লেখান নেইমার।


প্রশংসার সাথে সাথে বিতর্কও রয়েছে
হালকাপাতলা গড়নের কারণে সত্যিই দ্রুত পড়ে যান, নাকি ইচ্ছে করেই বেশি অভিনয় করেন প্রতিপক্ষকে বিপদে ফেলার জন্য? নেইমারকে নিয়ে এই বিতর্কটা চলছে বেশ কিছুদিন ধরেই। সাম্প্রতিক সময়ে বিতর্কটা আরও উসকে দিয়েছে নতুন এক পরিসংখ্যান। লা লিগায় এখন পর্যন্ত বেশি ফাউলের শিকার হয়েছেন এই ব্রাজিলিয়ান তারকা। তাঁর কারণে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের কার্ড দেখার ঘটনাও সবচেয়ে বেশি। চেলসি, ভ্যালাদোলিদ, সেল্টিকের কোচেরা তো বেশ ক্ষেপেই আছেন নেইমারের ওপর। তাঁদের মতে, ব্রাজিলিয়ান এই ফরোয়ার্ড ইচ্ছে করেই পড়ে যান সুবিধা আদায়ের জন্য।
তবে ভিন্নমতও আছে অনেকের। নেইমারের খেলার ধরন, দ্রুতগতির ড্রিবলিংয়ের কারণে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়রা ফাউল করতে বাধ্য হন বলেও মনে করেন অনেকে। স্প্যানিশ পত্রিকা ‘মার্কা’ পরিচালিত একটি জরিপ তেমনটাই সাক্ষ্য দিয়েছে। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৬৩.৯ শতাংশই মনে করেন যে, নেইমার সত্যিই ফাউলের শিকার হন। ৩৬.১ শতাংশের মতে, নেইমারের মধ্যে দ্রুত পড়ে যাওয়ার প্রবণতা আছে।


নেইমার নামের ছড়াছড়ি
কয়েক বছর পর দক্ষিণ আমেরিকার দেশ বলিভিয়ার রাজধানী লা পাজের পথেঘাটে হয়তো হাজারো নেইমারের দেখা মিলবে! এক গবেষণায় জানা গেছে, বলিভিয়ায় প্রতি ১০০ শিশুর মধ্যে ২০ জনের নাম রাখা হচ্ছে ‘নেইমার’! বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে ১৭ বছরের মধ্যে রাজধানী লা পাজের বেশিরভাগ প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের নাম হবে নেইমার।
ব্রাজিলের সবচেয়ে জনপ্রিয় ফুটবলার
ব্রাজিলে সবচেয়ে জনপ্রিয় ফুটবলার এখন স্ট্রাইকার নেইমার ডি সিলভা। দক্ষিণ আমেরিকার ফুটবল পরাশক্তি ব্রাজিলের মাটিতে সম্প্রতি চালানো এক সমীক্ষা থেকে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। চলতি বছরের ২৫ আগস্ট থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্টোকোস স্পোর্টস অ্যান্ড এন্টারটেইনমেন্টের চালানো এ সমীক্ষায় দেখা যায়-শতকরা ৩২.১ ভাগ ভোট পেয়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় ফুটবলারের তকমাটা জিতে নিয়েছেন বার্সার তারকা প্লেমেকার নেইমার।
নেইমারের শীর্ষ ১০টি গোল
পরিবার
পরিপূর্ণ যৌবনলাভের আগেই বান্ধবী ক্যারোলিনা ডান্টাস (Carolina Dantas) এর গর্ভে নিজের সন্তানের জন্ম দিয়ে বাবা হয়েছিলেন। ছেলের নাম রাখা হয় David Lucca da Silva Santos।




নেইমার ও ক্যারোলিনার সাথে জুনিয়র নেইমার
নেইমারের পরিবারের কিছু ভিডিও চিত্র
সংক্ষিপ্ত পরিসংখ্যান
বয়সভিত্তিক দল থেকে শুরু করে জাতীয় দল পর্যন্ত সবধরনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে (নভেম্বর, ২০১৩) পর্যন্ত ৬৬ ম্যাচ খেলেছেন নেইমার ব্রাজিলের জার্সি গায়ে। সব মিলিয়ে গোল করেছেন ৫৬টি। ২০১২ সালে স্যান্তোসের হয়ে সর্বাধিক ৪৩ গোল করে লাতিন আমেরিকার বর্ষসেরা ফুটবলার হয়েছিলেন।
এক নজড়ে
-
পুরো নাম : নেইমার দা সিলভা সান্তোস জুনিয়র
-
ডাক নাম : নেইমার
-
জন্ম : মগি দা ক্রুজ, সাও পাওলো, ব্রাজিল, ৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯২
-
পেশাদার ফুটবলে অভিষেক : মার্চ, ২০০৯
-
জাতীয় দলে অভিষেক : জুলাই, ২০১০
পরিসংখ্যান
ক্লাব ফুটবল
ক্লাব
|
সেশন
|
মোট গোল সংখ্যা
|
সান্তোস
|
২০০৯
|
১৪
|
২০১০
|
৪২
|
২০১১
|
২৪
|
২০১২
|
৪৩
|
২০১৩
|
১৩
|
বার্সেলোনা
|
২০১৩-২০১৪
|
৮
|
(ডিসেম্বর ১১, ২০১৩ পর্যন্ত)
আন্তর্জাতিক ফুটবল
সাল
|
মোট গোল সংখ্যা
|
২০১০
|
১
|
২০১১
|
৭
|
২০১২
|
৯
|
২০১৩
|
১০
|
(নভেম্বর ১৯, ২০১৩ পর্যন্ত)
নতুন বান্ধবী ব্রুনা মারকুইজিন
নতুন বান্ধবী জুটিয়েছেন নেইমার। ১৭ বছরের সুন্দরী মডেলকন্যা ও অভিনেত্রী ব্রুনা মারকুইজিনের সঙ্গে প্রেম এখন ভালই জমেছে।



নেইমারের চুলের স্টাইল
ব্রাজিলিয়ান এই তরুণ তুর্কিকে একেক সময় একেকে ধরনের হেয়ার স্টাইলে দেখা যায়। আসুন দেখে নিই তার কিছু হেয়ার স্টাইল।






আপলোডের তারিখ: ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৪