রাজধানীর বাণিজ্যিক এলাকা তেজগাঁও। সড়কের পাশে বসেছে ছোট ছোট ভাপা পিঠার দোকান। শীতের আমেজ এখনো পুরোপুরি আসে নি। তবে এই সন্ধ্যেবেলাটায় গোসল করতে খানিকটা শীত অনুভব হয় সুজনের (১০)। তবুও দ্রুতই গোসল সেড়ে নিল সে। সড়কের পাশেই একটা বস্তিতে থাকে। সড়কের পাশে ঝুপড়ি ঘরগুলোই বস্তি। বলতে পারেন তাদের গ্রাম বা এলাকা কিংবা একটা ছোট্ট পৃথিবী। এখানেই বেড়ে ওঠে তারা। মুখোমুখি হয় চরম বাস্তবতার। তারপর একদিন চোখে নেশাতুর স্বপ্ন নিয়ে বেরিয়ে পড়ে অন্য পৃথিবীতে।
তবে আজ তাড়াহুড়ো করছে অন্য কারণে। বেশ দেরি হয়ে গেছে তার। আসলে ইচ্ছে করে করেনি। গ্যারেজে শেষ সময়ে একটা গাড়ি চলে এসেছিল। পরিষ্কার করতেই দেরি হয়ে গেল। ও, বলাই হয়নি। সুজন কাজ গ্যারেজে। সারাদিন গ্যারেজে ফুট ফরমায়েশ খেটে এই সন্ধ্যাবেলাটাতেই একটু পরিচ্ছন্ন কাপর পরে সে। গত ঈদে কেনা লাল শার্ট টা পরেছে আজ। মাথায় হালকা করে সরষের তেলও দিয়েছে। তারপর শিপনদের বাড়ি হয়ে সোজা তেলের পাম্পে। সেখানেই তার সঙ্গে আমার, গল্প হল তার ব্যস্ত সন্ধ্যাটা নিয়ে।
শুধু সুজন নয়। তারমতো অনেকেই এসেছে রাজধানীর নাবিস্কোর এই তেলের পাম্পে। একসময় সন্ধ্যাটা যাদের খোশ গল্প করে, ভিক্ষা করে কিংবা অন্য কিছু করে অন্ধকারেই কাটতো তারা এখন তেলের পাম্পের ঝকঝকে আলোর নিচে কাটায়। আর এই আলোর আলোকবর্তিকাটা জ্বালিয়েছেন জিহাদ আরিফ। তিনি ছিন্নমূল এই শিশুগুলোকে প্রতিদিন সন্ধ্যা আটটায় পড়ান। পড়ান বললে পুরোটা বলা হয় না। জিহাদ আরিফের ভাষায়, তাদের চোখে স্বপ্ন জাগান, মনে আত্মসম্মান বোধ জাগান।
এই পথ স্কুলটার একটা নাম দিয়েছেন তিনি ‘এডুকেশন ফর ইন্ডিপেন্ডেন্ট’। মোট ৪১ জন শিশুকে পারদর্শীতার ভিত্তিতে ৪টি ‘ক্যাটাগরি’তে পড়ান তিনি। এর মধ্যে সবচেয়ে শেষ ক্যাটাগরির নাম ‘রজনীগন্ধা’, দ্বিতীয় শ্রেণীর সমমান। যারা রজনীগন্ধায় পড়ে তাদের আর কিছুদিন পরেই ‘মূলধারা’র পড়াশুনা করাতে স্কুলে ভর্তি করাবেন তিনি।
একাজ নিয়ে রীতিমত গবেষণা করছেন তিনি। গবেষণার বিষয়, ‘নদী ও শিশু’। কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম, ‘নদীর সঙ্গে আবার শিশুর সম্পর্কটা কী?’ খুলনার এই তরুণ তুর্কী হেসে বললেন, ‘আছে। আমি দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ। আমরা যারা দক্ষিণ বঙ্গে নিয়মিত যাতায়াত করি, তারা জানি। বন্যা-আইলা-সিডরের নিউজ করে অনেক ‘সাংবাদিক’ স্টার খ্যাতি পেয়েছেন! কিন্তু এখন কী অবস্থা গিয়ে আসুন। পানিতে লবন, ভাতে লবন এমনকি গরুর দুধও লবনাক্ত! আমারতো মনে হয় এটা টেস্ট করা উচিৎ যে, কতটুকু জল লবনাক্ত হল সাগরের জলে আর কতটুকু হয়েছে চোখের জলে।’
বলছিলেন, ‘আসলে এ অঞ্চলের অনেক মানুষ তাদের বাসস্থান হারিয়ে এখন নিঃস। এই দারিদ্রের পেছনে নদীর হাত অনেকখানি। তাই নদীর থাবা থেকে বাঁচতে অনেকেই পারি জমাচ্ছেন ঢাকায়। আবার কোনো কোনো শিশু বিভিন্নভাবে পরিবার ছাড়াই এসে ঠাঁই নিচ্ছে ঢাকার রাস্তায়। তাই নদী ও শিশু যায়গাতেই ভাবার বিষয় আছে।’
কথা হল এরকম উদ্যোগে আসার কারণ নিয়েও। নির্বাচনের আগে আমাদের দুই নগরপিতার বক্তব্য ছিল ‘বাসযোগ্য ঢাকা চাই’, ‘আধুনিক ঢাকা চাই’। আমার মনে হয় আমরা যদি বাসযোগ্য ঢাকা চাই তাহলে এদের বাদ দিয়ে নয়। এই যে ‘দলিত সম্প্রদায়’ আছে তাদের বাদ দিয়ে আধুনিক ঢাকা করা যাবে কিনা এটা একটা ভাবার বিষয়। এমনটা ভাবনা জিহাদ আরিফের।
আরো বললেন, ‘কিছুদিন আগে নেপালে মর্মান্তিক ভুমিকম্প হল। এর আগে কিন্তু ‘ইতর শ্রেণী’ মাটি থেকে উপরে উঠে আসছে। আপনার কাছে এটা প্রাচীন ধারণা মনে হতে পারে। কিন্তু তারা প্রকৃতির উপাদান। তারা বুঝতে পেরেছিল প্রকৃতির আক্রমণ আসছে। আর আমি যদি এই পথশিশুদের দিকে তাকাই তারাও আমার কাছে তেমনি দেখায়। অন্তত আমরা তাদের সেরকমই ভাবি বা মনে করছি। এই ‘ইতর শ্রেণীরা যখন বলবে আমার ঢাকায় থাকতে ভালো লাগে না। তখন বুঝতে হবে প্রকৃতি ভালো নেই। পরিবেশের দিক দিয়ে প্রকৃতির সাথে যখন আপনি অন্যায় করবেন তখন প্রকৃতি প্রতিশোধ নিবেই।’
আমরা নিম্ন আয়ের দেশ থেকে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হয়েছি। উন্নত দেশ হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করছি আর এত বড় একটা গোষ্ঠীকে অন্ধ করে রাখছি। এই অন্ধকার একদিন আমাদের লজ্জা দেবে। আমি কখনো ভাবিনা এরা বিসিএস ক্যাডার হবে এরকম বড় স্বপ্ন আমি দেখিনা। যে মহান একুশে ফ্রেব্রুয়ারির জন্য আমরা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পেয়েছি। সেই দিবসের ভাষাটা যেন পড়তে পারে। নিজেকে যেন চিনতে পারে একটুকুই চাই।
এদের খরচ কীভাবে চলে জানালেন জিহাদ, ‘আমি একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করি। আমার পিছুটান তেমন একটা নাই। একেবারেই নাই তা না আসলে আমার ফ্যামিলি টান তেমনটা নেই। ওদের খাতা-পেন্সিল-বই আমিই চালাই। আমি চাই না এটা একটা দাতব্য সংস্থা হোক। আমি এখানের সর্বসর্বা থাকতে চাই না। ওরাই ওদের সংগঠন চালাবে। একটা পাখি যখন ডালে বসে, সে ডালের ওপর ভরসা করে না। তার পাখার ওপর ভরসা করেই বসে। আমি ডালের ভুমিকায় থাকলেও ওরা নিজেদের বলেই থাকবে।’
একটা সুন্দর স্বপ্ন আছে জিহাদের। এই স্বপ্নপূরণে কারো কোনো সহযোগিতা চান কিনা- এমন প্রশ্নে জানালেন সাবলিলভাবেই। এখনই আর্থিক সহযোগিতাটা চান না। তবে চাইলে তাদের এখানে এসে যুক্ত হতে পারেন। পরামর্শ দেবেন, এরপর সবাই মিলেই উদ্যোগ নিবেন কী করা যায়! কিছুদিন আগে একটা স্কুলে কথা বলেছিলাম। আমরা মূলত সন্ধ্যা বেলাটায় আমরা সেখানে ক্লাস নিতে চেয়েছিলাম। অন্তত বারান্দাটা দিলেও চলতো। কিন্তু উনারা রাজি হননি।’
‘অবশ্য এখন আর রুমের ভাবনাতে নাই। আমি চাই এই শিশুগুলোর জন্য একটা কর্মসংস্থান হোক। তারা কাজ করেই তাদের পড়াশুনার খরচ চালাবে। পাশাপাশি তারা বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজ থেকে বেরিয়ে আসবে। তাদের কারিগরি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে গড়ে তুলতে চাই।’ বলেও জানালেন তিনি।
শিশুদের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ আলাপ হল। ছোট খাটো বিষয়ে জিহাদ আরিফের কাছে তাদের আবদার, ‘স্যার, আমি লিখি?’ ‘স্যার, আমি পানি খাইতে গেলাম।’ আর এসব মধুর যন্ত্রণা হাসিমুখে ‘সয়ে’ যাচ্ছেন। আর স্বপ্নের চারাগাছটায় পানি দিচ্ছেন রোজ।