সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীতে মানুষ পাঠিয়েছেন অতি যত্ন করে। অতিশয় যত্ন করে তিনি মানুষের নাক, চোখ, মুখ সহ অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সৃষ্টি করেছেন। নাক, চোখ, মুখ সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত মানুষের অতি মূল্যবান এবং শ্রেষ্ঠ সম্পদ। কিন্তু আমাদের চারপাশে অনেক মানুষ আছে যাদের কারোও হাত, কারোও পা নেই, কারও চোখ নেই। কেউবা আবার কথা বলতে পারে না, কেউ কানে শোনে না। কিন্তু এতসব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও অনেক মানুষ নিজ গুণে তাদের নিজেদেরকে করেছেন মহিমান্বিত ও সম্মানিত এবং শ্রেষ্ঠ। তেমনই একজন হলেন হেলেন কিলার। যিনি জন্মেছিলেন স্বাবাভিক ভাবে। কিন্তু মাত্র ১৯ মাস বয়সেই তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে তার দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি ও কথা বলার শক্তি হারান। অর্থাৎ বেঁচে থেকেও একজন মৃত মানুষ হয়ে ছিলেন। কিন্তু অদম্য সাহস আর ইচ্ছাশক্তির কাছে হার মেনেছিল তার সমস্ত প্রতিকূলতা। সমস্ত প্রতিকূলতাকে জয় করে তিনি হয়ে আছেন আজও অমর এবং শ্রদ্ধাভাজন। কি করেছেন তিনি? কিভাবেই বা সম্ভব হল তার সমস্ত প্রতিকূলতা জয় করা? আসুন আজ জেনে নিই হেলেন কিলার সম্পর্কে বিস্তারিত।
পরিচয় ও শৈশবকাল:
হেলেন কিলারের পুরো নাম হেলেন এ্যাডামস কিলার। ১৮৮০ সালের ২৭ জুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলর আলবামার তুসকাম্বিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এ মহীয়সী নারী। তার বাবার নাম আর্থার কিলার এবং মায়ের নাম ক্যাট এ্যাডামস কিলার। তিনি একাধারে একজন লেখক, রাজনৈতিক কর্মী, মানবতাবাদী। হেলেনের বয়স যখন মাত্র ১৯ মাস তখন তিনি মারাত্মকভাবে জ্বরে আক্রান্ত হন। এসময়ে অন্ধ বধীর ও বোবা হয়ে যান। ফলে তার বাবা-মা তার বেঁচে থাকার আশা ছেড়ে দেন। তথাপি তারা তার চিকিৎসা বন্ধ করেননি। হেলেনের বয়স যখন ৬ বছর তখন তার বাবা-মা তাকে আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলের কাছে নিয়ে যান হেলেনের চিকিৎসা করার জন্য। গ্রাহামবেল তখন মাত্রই টেলিফোন আবিষ্কার করেছেন এবং ঐ সময়ে তিনি অন্ধ ও বধিরদের জন্য দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছিলেন। বেল হেলেনকে পরীক্ষা করে জানালেন যে হেলেন আর কোনদিনই দেখতে বা শুনতে পারবে না। তবে তিনি হেলেনের বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা করলেন। তিনি জানালেন যে পরিকল্পনা অনুযায়ী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে হেলেনের পক্ষে স্বাভাবিক জীবনের কাছাকাছি একটি সুন্দর জীবন পুনরায় ফিরে পাওয়া সম্ভব।
পড়াশুনা ও বেড়ে ওঠা:
পরিবারের উৎকণ্ঠা ও হতাশার মাঝেই শুরু হয় হেলেন কিলারের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ। ৮ বছর বয়সে এ্যানি সুলিভান নামের এক গৃহশিক্ষিকা তার পড়াশোনার দায়িত্ব নেন যিনি নিজেও একজন অন্ধ ছিলেন। এ্যানি সুলিভান সার্বক্ষণিক হেলেনের পাশে থাকতেন। হেলেনের সমস্ত কাজে এ্যানি সাহায্য করতেন। এভাবেই তাদের দুজনের সম্পর্ক স্থায়ী হয় ৪৯ বছর। এ্যানি প্রথমে আঙুল দিয়ে হেলেনের হাতে বিভিন্ন চিহ্ন এঁকে এবং এরপর বর্ণমালা কার্ড দিয়ে বর্ণমালা শেখান। মাত্র ৮ বছর বয়সেই তিনি হাতের আঙ্গুল দিয়ে দাগ কেটে কেটে লেখা, ব্রেইল পদ্ধতিতে লেখাপড়াসহ শব্দ ও বাক্য উচ্চারণ পর্যন্ত শিখে ফেলেন। তারপর তাকে ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়াশোনা করান। ১৮৯০ সালে ১০ বছর বয়সে নরওয়েতে উদ্ভাবিত পদ্ধতি অনুসরণ করে কথা বলা শেখেন হেলেন। এতে পরিবারের লোকজন ও আত্মীয়-স্বজনরা অবাক হয়ে যান। ১৯৯৪ সালে যখন তার বয়স ১৪, হেলেন নিউইয়র্কের ‘রাইট হামসন’ স্কুলে ভর্তি হন। এখানে বিশ্ববিখ্যাত লেখক মার্ক টোয়েনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। ১৯০০ সালে তিনি রেডক্লিফ কলেজে ভর্তি হয়ে ১৯০৪ সালে মাত্র ২৪ বছর বয়সে প্রথম দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হিসেবে ব্যাচেলর অব আর্টস ডিগ্রী অর্জন করেন। এই ডিগ্রী অর্জনের আগেই ১৯০৩ সালে তার আত্মজীবনী ‘দ্যা স্টোরি অব মাই লাইফ’ প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে তিনি অর্জন করেছেন ডক্টরেট ডিগ্রী।
হেলেনের যোগাযোগ করতে শেখা:
এ্যানি সুলিভান হেলেনকে অন্য মানুষের সাথে যোগাযোগ করতে শিখিয়েছেন। প্রথমদিকে হেলেন এ্যানি সুলিভানের শিখিয়ে দেওয়া নির্দেশ অনুযায়ী হাত উঠাতে না পেরে খুবই হতাশ হয়ে যেতেন। যাই হোক এভাবে এক মাস চলার পর সুলিভানের দেওয়া হাতের ইশারা মতো পানি শব্দটি শিখে ফেলেন। সুলিভান হেলেনের বাম হাতে পানি ঢালতেন এবং ডান হাতে পানি শব্দটি লিখতেন। এই ব্যাপারটি হেলেনকে পদ্ধতিটি পুরোপুরি আয়ত্ত করতে সাহায্য করে। এভাবে হেলেন কিছুদিনের মধ্যেই গৃহস্থালির বেশ কয়েকটি জিনিস চিনতে পারে। এভাবে হেলেন দ্রুত উন্নতি করতে থাকে। সে দ্রুতই ব্রেইল পদ্ধতিতে দক্ষ হয়ে ওঠে এবং ফলপ্রসূ শিক্ষা লাভে সমর্থ হয়। হেলেন আশাতীত উন্নতি করতে থাকে। পরবর্তীতে সে ব্রেইল টাইপরাইটারে লিখতে শিখে। রেডক্লিফ কলেজে পড়ার সময় হেলেন কথা বলতে শেখে এবং মুখে পড়ার অনুশীলন করে। তার স্পর্শের অনুভূতি ছিল অত্যন্ত সূক্ষ্ণ। এভাবেই হেলেন কথা বলা এবং লেখাতে দক্ষ হয়ে ওঠে।
রাজনীতি ও সমাজসেবা:
হেলেন রাজনৈতিক বিষয় নিয়েও লেখালেখি করেছেন। হেলেন ছিলেন American Socialist Party-র সমর্থক। তিনি সেখানে ১৯০৯ সালে যোগদান করেন। তিনি আয়ের সুষম বণ্টন দেখতে চাইতেন। ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার অসমতার শেষ দেখাই ছিল তার ইচ্ছা। তার বই ‘Out of The Dark’-এ এই বিষয়ে আলাদা আলাদা রচনা লিখেছেন। প্রত্যেকটি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তিনি Eugene V Debs এর সমর্থন পেয়েছেন। ১৯১২ সালে তিনি Industrial Workers of the World (IWW)- যোগদান করেন। হেলেন ছিলেন একজন Pacifist এবং তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার জড়িত থাকার বিরুদ্ধে ছিলেন।
১৯১৮ সাল থেকে হেলেন তার জীবনের অধিকাংশ সময় অন্ধদের জন্য তহবিল সংগ্রহ ও সচেতনতা সৃষ্টির কাজ অতিবাহিত করেছেন। এসময় তিনি নিজের প্রতিবন্ধকতার কথা উপলব্ধি করে বাক-শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী দের জন্য গড়ে তোলেন নতুন নতুন সমিতি ও স্কুল। সমাজের বাক-শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি ও গণমানুষের সহায়তা অর্জনে হেলন প্রচেষ্টা চালান। এতে তিনি ব্যাপক সফলতা পান। তার জীবদ্দশায় আমেরিকার সকল রাষ্ট্রপতি এবং আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল, মার্ক টোয়েন, চার্লি চ্যাপলিনের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিগণ তাকে সহায়তা পাঠান। তিনি ১৯১৫ সালে জর্জ কেসলারকে সাথে নিয়ে ‘হেলেন কিলার ইন্টারন্যাশনাল’ নামের একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা গড়ে তোলেন। সংস্থাটি এখনও বাক-শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য কাজ করে যাচ্ছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪১ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের অনুরোধে হেলেন বিভিন্ন হাসপাতালে যান। সেখানে তিনি যুদ্ধাহত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নাবিক ও সৈনিকদের উৎসাহিত করতেন ও সাহস যোগাতেন এবং আশার কথা শোনাতেন। যুদ্ধ শেষে বাক-শ্রবণ ও দৃষ্ট-প্রতিবন্ধী দের জন্য বিশ্বব্যাপী এক আন্দোলন গড়ে তোলেন।
বিশেষ কিছু:
-
হেলেন তার জীবনে প্রায় ১১ টি বই রচনা করেছেন। এগুলোর মধ্যে প্রধান হচ্ছে দি স্টোরি অব মাই লাইফ, দি ওয়াল্ড আই লিভ ইন, ওপেন ডোর, আউট অব দি ডার্ক ইত্যাদি।
-
অনেক দৃষ্টিসম্পন্ন জ্ঞানী মানুষের চেয়েও হেলেন বেশি বই পড়েছেন।
-
তিনি বাক, শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য একটি চলচিত্র রচনা করেছেন যেখানে তিনি নিজেই নিজ ভূমিকায় অভিনয় করেছেন।
-
বাদ্যযন্ত্রের উপর হাত রেখেই তাতে কি সুর বাজছে তা বলতে পারতেন। দীর্ঘদিন পরেও কারও সাথে হাত মেলালে বলে দিতে পারতেন লোকটি কে।
-
তিনি নদীতে সাতার কাটতে পারতেন। নৌকা চালাতে পারতেন। ঘরে বসে নকশী কাথা সেলাই করতে পারতেন।
-
তিনি দাবা, তাসও খেলতে পারতেন।
-
১৯৫৯ সালে হেলেন জাতিসংঘ কর্তৃক বিশেষ সম্মানে ভূষিত হন।
-
হেলেনর লেখা একটি কবিতা
"They took away what should have been my eyes
But I remember Milton's Paradise
They took away what should have been my ears
Beethoven came and wiped away my tears
They took away what should have been in my tongue
But I had talked with God when I was young
He would not let them take away my soul
Possessing that I still possess the whole."
ভাষান্তর:
"আমার দৃষ্টিদ্বয় তারা সরিয়ে নিল
যেখানে যা হওয়া উচিৎ ছিল
কিন্তু আমি স্মরণ করি মিল্টনের স্বর্গখনি,
আমার শ্রবণদ্বয় তারা সরিয়ে নিল
যেখানে যা হওয়া উচিৎ ছিল
বীথোভেন এসে মুছালো আমার চোখের পানি।
আমার জিহবা তারা সরিয়ে নিল
যেখানে যা হওয়া উচিৎ ছিল
যখন আমি ছোট ছিলাম
ঈশ্বরের সাথে কত কথা,
সম্পূর্ণ পোষণ করি
তিনি তাদের অনুমতি দিবেন না
সরিয়ে নিতে আমার আত্মা।"
মৃত্যু:
১৯৬৮ সালের ১লা জুলাই হেলেন কিলার পরোলোকগমন করেন। তার স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য এবং তার অসামান্য কৃতিত্বের জন্য ১৯৭৭ সালে ‘আমেরিকরন এসোসিয়েশন ফর দি ওভারসীজ ব্লাইন্ড’ যার বর্তমান নাম হেলেন কিলার ইন্টারন্যাশনাল গঠন করা হয়েছে।