পশ্চিমা দুনিয়ার লোকেদের চোখে ১৩ একটি অশুভ সংখ্যা। এপোলো ১৩ অভিযানটি যেন সে ধারণাকেই পাকাপোক্ত করেছে। এটি ছিল মানুষ্যবাহী সপ্তম মহাকাশযান এবং চাঁদে মানুষের তৃতীয় অভিযান।
যারা ছিলেন এ অভিযানে
অভিযানে নভোচারী হিসেবে ছিলেন জেমস লভেল, জ্যাক সুইগার্ট ও পাইলট ফ্রেড হেইজ।
জ্যাক সুইগার্টের জন্য এটি ছিল প্রথম মহাকাশ যাত্রা। সে সময় তার বয়স ছিল ৩৮। তাকে কমান্ড মডিউলের জন্য ব্যাকআপ হিসেবে রাখা হয়েছিল। যাওয়ার কথা ছিল কেন ম্যাটিংলির। কিন্তু জার্মান মেজেল ধরা পড়ার পর তিনি বাদ পড়েন।
৪২ বছর বয়সী জেমস লভেল ছিলেন সবচেয়ে বেশি সময় মহাকাশে কাটানো নভোচারী। ৫৭২ ঘন্টা মহাকাশে কাটানোর অভিজ্ঞতা ছিল তার। চন্দ্র প্রদক্ষিণের প্রথম অভিযান এপোলো ৮-এ অংশ নেবার পাশাপাশি দু’টো জেনিনি মিশনে অংশ নিয়েছিলেন।
আর ৩৬ বছর বয়সী ফ্রেড হেইজ এপোলো ৮ এবং ১১ মিশনের ব্যাকআপ হিসেবে প্রস্তুত ছিলেন।
দূর্ঘটনাটি ঘটেছিল ৫৬ ঘন্টার মাথায়
পঞ্চম এবং ষষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে চাঁদের মাটিতে পা রাখার কথা ছিল মহাকাশ যানে থাকা লভেল এবং হেইজের। ফারা মাউরো পাহাড়ে আরোহণের কথা ছিল তাদের। এটি চন্দ্রপৃষ্ঠের একটি উঁচু এলাকা যার ব্যাস প্রায় ৮০ কিলোমিটার। কিন্তু এসবের কিছুই হয় নি। ৫৬ ঘন্টার মাথায় ঘটে যাওয়া একটি বিস্ফোরণের ফলে নভোচারীদের অন্য লড়াই শুরু হয়, সেটি হচ্ছে পৃথিবীতে বেঁচে ফেরার লড়াই। নিচে নাসার মিশন কন্ট্রোল রুমে স্বস্তি এবং আনন্দের যে আবহ ছিল দু’দিনের মাথায় তা বিলীন হয়ে যায়। সে সময় পৃথিবী থেকে দুই লক্ষ মাইল দূরে ছিল নভোযানটি।
উক্ষেপণটাও ভালো হয় নি
১৯৭০ সালের ১১ এপ্রিল ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে রকেট উৎক্ষপণ করা হয়। বিপদের ঝুঁকিটা তৈরি হয়েছিল উৎক্ষেপণের সময় থেকেই। ভি রকেটের দ্বিতীয় ধাপ ইঞ্জিন নির্ধারিত সময়ের দু’মিনিট আগেই বন্ধ হয়ে যায়, ফলে কক্ষপথে পৌঁছাতে অন্য ইঞ্জিনগুলোকে আরও বেশি সময় কাজ করতে হয়, সাথে অতিরিক্ত জ্বালানিও খরচ হয়।
বিপর্যয়ের শুরু জ্বালানি ট্যাংকের বিস্ফোরণ থেকে
দু’দিন পর তাদের অক্সিজেন ট্যাংকে বিস্ফোরণ ঘটে, সার্ভিস মডিউল অকেজো হয়ে পড়ে, যার ওপর কমান্ড মডিউল নির্ভরশীল। কেবিনের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়ে, পানি ও জ্বালানি ঘাটতি তৈরি হয়, কেবিনের কার্বন ডাই অক্সাইড অপসারণ ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়ে। এতসবের পরও তিনজন ক্রু ১৭ এপ্রিল নিরাপদে ফিরে আসতে সক্ষম হন। জরুরী নয় এমন সবকিছুই বন্ধ করে দেয়া হয়। কেবিনের তাপমাত্রা হিমাংকের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। এ তাপমাত্রায় খাওয়ার অযোগ্য হয়ে পড়ে তাদের জন্য সংরক্ষিত কিছু খাবারও। ক্রুদের জন্য এটি ছিল দীর্ঘ কয়েকটি দিন। সবাই ওজন হারিয়েছিলেন, হেইজের কিডনীতে সংক্রামণ দেখা দেয়।

বিবিসি সাংবাদিকের স্মৃতিচারণ
অত্যন্ত কাছে থেকে এ দূর্ঘটনার রিপোর্ট করেছিলেন বিসিসি’র সাংবাদিক রেগ টার্নিল। এক সাক্ষাৎকারে তিনি দূর্ঘটনাটির স্মৃতিচারণ করেন। ১৩ এপ্রিল তারিখে বিবিসির এই সাংবাদিক স্ত্রী’র সাথে রাতের খাবার খেয়ে নাসার জনসন স্পেস সেন্টারে ফিরেছিলেন। সব ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে নিলেন তিনি। এরপর বিবিসি’র সকালের খবরের জন্য এক মিনিটের একটি বুলেটিন তৈরি করলেন।
তিনি প্রায় বেরিয়ে এসেছিলেন, আর তা করলে সেটা তার সাংবাদিক জীবনের জন্য একটি কলঙ্কই হয়ে থাকতে পারত। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তিনি শুনতে পেলেন, ‘হিউস্টন আমাদের এখানে একটি সমস্যা হয়েছে’। তিনি ডেস্কে ফিরে যান এবং পরের তিনটি দিন সেখানেই কাটিয়ে দেন। এটি ছিল চন্দ্রপৃষ্ঠে নাসার তৃতীয় অভিযান।
নভোচারী জিম লোভেলের বর্ণনায়
তিনটি ফুয়েল সেলের মধ্যে দুটিই হারায় এপোলো ১৩। নভোচারী জিম লোভেল দেখতে পান অক্সিজেন ফুরিয়ে গেছে। তারা বুঝতে পারছিলেন না যে তাদের যন্ত্রপাতি এলোমেলো আচরণ করছে, নাকি সত্যি অক্সিজেন ফুরিয়ে গেছে। ১৩ মিনিটের মাথায় লভেল আবিস্কার করেন অক্সিজেন বেরিয়ে মাহাশূন্যে চলে যাচ্ছে।
সার্ভিস মডিউলে থাকা দু’টি অক্সিজেন ট্যাংকের একটি বিস্ফোরিত হয় যা অন্যটির নলও নষ্ট করে দেয়, বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয় ফলশ্রুতিতে এপোলো ১৩ এর অক্সিজেন এবং পানির রিজার্ভ অত্যন্ত সীমিত হয়ে পড়ে।
নাসার তৎপরতা
কেউই বুঝতে পারছিল না এ অবস্থায় কি করা উচিত। নামজাদা প্রকৌশলী এবং নভোচারীরা নাসায় ছুটলেন। এদের মধ্যে ছিলেন নীল আর্মস্ট্রং এবং বাজ অলড্রিন। তারা সিমুলেটর ব্যবহার করে এই তিন নভোচারীকে ফিরিয়ে আনার উপায় খুঁজতে থাকলেন। জরুরি নয় এমন সব যন্ত্রপাতি বন্ধ করে ফুয়েল সেলের অক্সিজেন এবং হাইড্রোজেনের খরচ কমানো হয়।
একটি দলগত প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল তখন। লুনার ল্যান্ডারটিকে লাইফবোট হিসেবে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়। এখানে ব্যাটারী, অক্সিজেন, পানি ইত্যাদি ছিল। এটি ব্যবহার করেই চাঁদের পিঠে নামার পরিকলপনা ছিল নভোচারীদের।
পৃথিবীতে আর কোনদিন পৌঁছাতে পারবেন না সে আলোচনা থেকে বিরত ছিলেন তারা
এক সাক্ষাৎকারে জিম লভেল জানান সে সময় তারা কি ঘটেছে সেটা বোঝার চেষ্টা করছিলেন, এবং অলৌকিক কিছুর আশায় ছিলেন যাতে তারা পৃথিবীতে পৌঁছতে পারেন। তারা হয়ত আর কখনো পৃথিবীতে পৌঁছাতে পারবেন না, সে সম্ভাবনা নিয়ে কোন আলাপই নিজেদের মধ্যে করেন নি।
পৃথিবীতে ফিরে আসা
চাঁদের আকর্ষণ বলকে ব্যবহার করে পৃথিবীতে ফেরার পরিকল্পনা করেন তারা। চাঁদ প্রদক্ষিণ করতে শুরু করেন। এ সময় চাঁদের অন্ধকার দিকটির চমৎকার ছবি নিতে সক্ষম হন তারা। তবে সেখানে অবতরণ করা হয় নি তাদের!
যখন নভোচারীরা পুথিবীর বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করতে চলেছেন সেই মুহূর্তটি ছিল অত্যন্ত উৎকন্ঠার। নভোচারীরা বাঁচবেন না মরবেন তা বলতে পারছিল না কেউ। কারণ নভোযানের গায়ে যে হিট শিল্ড আছে তা যদি বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে তবে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে প্রবেশের সাথে সাথে আগুন ধরে যেতে পরে।
লাখ লাখ মানুষ টেলিভিশনের পর্দায় বিষয়টির ওপর নজর রাখছিলেন। সবার একটাই কামনা নভোচারীরা যেন জীবিত ফেরেন। নভোচারীদের পরিবারের সদস্যদের জন্য বিষয়টি ছিল আরও উৎকন্ঠার। গণম্যধ্যমেরও নজর ছিল তাদের ওপর, তাদের যথেষ্ট সম্মানের সাথে উপস্থাপন করছিল তারা।

প্যারাস্যুটে ঝুলে কমান্ড ক্যাপসুলটি যখন মেঘের মধ্য থেকে দৃশ্যমান হল তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সবাই। ক্যাপসুলটি প্রশান্ত মহাসাগরে ওপর দ্বীপ রাষ্ট্র টঙ্গার কাছে পড়ে এবং সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্র নৌবাহিনীর একটি জাহাজ নভোচারীদের উদ্ধার করে।
আরও ভয়াবহ হতে পারত বিষয়টি
পরে এটা স্পষ্ট হয় যে দূর্ঘটনাটি অনেক মারাত্নক হতে পারত। অক্সিজেন ট্যাংকের বিস্ফোরণে ৬০,০০০ পিএসআইএ (পাউন্ডস পার স্কয়ার ইঞ্চ অ্যাবসল্যুট) চাপ তৈরি হয়েছিল, যা ৭১ পাউন্ড টিএনটি’র সমতূল্য। এ পরিমাণ টিএনটি তিন হাজার বর্গমিটার এলাকার বাড়ি গুঁড়িয়ে দিতে পারে।
বিস্ফোরণের ফলে প্যানেলটি উড়ে না গেলে কমান্ড মডিউলের হিট শিল্ড এবং সার্ভিস মডিউলের ওপর উচ্চচাপ তৈরি হত। এপর ফলে সার্ভস মডিউল এবং কমান্ড মডিউলের জোড়া নষ্ট হয়ে যেত। মডিউল দু’টি কেবল অক্সিজেন এবং বিদ্যুৎ নরবরাহ লাইনের মাধ্যমে যুক্ত থাকত। এ অবস্থায় মাঝের কামান্ড মডিউলটি স্রেফ ঝুলে থাকত। এরক পরিস্থিতিতে মহাকাশযানটি ঘোরানো অসম্ভব ছিল এবং লুনার মডিউলটিও ব্যবহার করা যেত না।
আবার বিস্ফোরণটিও যেন সবচেয়ে চেয়ে ভালো সময়ে ঘটেছিল। লুনার মডিউলটি চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে ঘুরে মূল যানে ফেরার পরও বিস্ফোরণটি ঘটতে পারত। কারণ লুনার মডিউলটি ব্যবহার করে ফেলার পরে বিস্ফোরণটি ঘটলে কিছুই করার ছিল না।
সফল ব্যর্থতা
প্রচলিত হিসেবে এপোলো ১৩ একটি ব্যর্থ অভিযান। তবু এটি পরিচিত ‘সফল ব্যর্থতা’ হিসেবে। বিচক্ষণতা আর দৃঢ়তার সাথে নভোযানটিকে ফিরিয়ে আনা ছিল প্রকৌশলী এবং নভোচারীদের জন্য একটি সাফল্য। নভোচারী জিম লভেলের মতে এ বিপর্যয় বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে যে যোগ্য নেতৃত্ব, দলগত প্রচেষ্টা, উদ্যোগ এবং অব্যাহত চেষ্টার মাধ্যমে প্রায় নিশ্চিত বিপর্যয় থেকেও রক্ষা পাওয়া সম্ভব। ১৯৯৫ সালে এ অভিযান নিয়ে চলচ্চিত্রও তৈরি হয়।
মহাকাশযানে পরিবর্তন এবং একই স্থানে সফল পদার্পণ
এ দূর্ঘটনার পর মহাকাশযানের নকশায় পরিবর্তন আনা হয়। পরের মহাকাশযানগুলোয় আরও ভালো বৈদ্যুতিক তার এবং অতিরিক্ত জ্বালানি ট্যাংক যুক্ত করা হয়। এ দূর্ঘটনা নাসার জন্য একটি কলঙ্ক হলেও দূর্ঘটনা সামাল দেয়াটা ছিল তাদের জন্য একটি সাফল্য। পরে এপোলো ১৪ মিশনের মাধ্যমে চন্দ্রপৃষ্ঠের একই জায়গায় মানুষ পাঠায় নাসা।
শিহাব উদ্দিন আহমেদ