বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত স্থাপনাগুলোর একটি প্যারিসের আইফেল টাওয়ার। ১৮৮৯ সালে নির্মাণকাজ সম্পন্ন হওয়ার পর দীর্ঘ ৪০ বছর বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু স্থাপনার খেতাব ধরে রেখেছিল এটি। ইউরোপের শিল্প বিপ্লবের প্রতীক হয়ে ওঠা আইফেল টাওয়ার আসলে ফ্রান্সে নির্মাণেরই কথা ছিল না। এর নির্মাণের জন্য কৃতিত্ব দেয়া হয় গুস্তাভ আইফেলকে। ধাতুর তৈরি অবকাঠামো নির্মাণে বিশেষ খ্যাতি ছিল তার। বেশ কিছু রেলসেতু এবং স্ট্যাচু অব লিবার্টির মত স্থাপনা আগেই তৈরি করে ফেলেছিলেন। ১৮৮৮ সালে বার্সেলোনার বিশ্ব-বাণিজ্য মেলার কথা মাথায় রেখে আইফেল টাওয়ারের নকশা করা হয়েছিল। কিন্তু এত টাকা খরচ করে এরকম ‘অদ্ভুত’ স্থাপনা নির্মাণ করতে রাজি হয়নি কর্তৃপক্ষ। পরের বছর অর্থাৎ ১৮৮৯ সালে ফরাসী বিপ্লবের শতবর্ষপূর্তি উদযাপনের জন্য আরেকটি বিশ্ব-বাণিজ্য মেলা আয়োজনের উদ্যোগ নেয় প্যারিস, আর এজন্য ১০০টির মত মনুমেন্টের নকশা জমা পরে। এ যাত্রায় গুস্তাভ আইফেলের নকশাটি নির্বাচিত হয়। ১৮৮৭ সালে শুরু হয়ে ১৮৮৯ সালে এসে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়। ৫০ জন প্রকৌশলী আলাদা আলাদাভাবে আইফেল টাওয়ারের বিভিন্ন অংশের জন্য মোট ৫,৩০০ টি নকশা তৈরি করেন আর টাওয়ারের জন্য মোট ৮,০০০টি অংশ আলাদা আলাদাভাবে তৈরি করে এনে জোড়া দেয়া হয়েছিল।
আজকের প্যারিস মানেই যেন আইফেল টাওয়ার। কিন্তু সেদিনের প্যারিসবাসীদের অনেকেই শৈল্পিক শহরে এমন ধাতব কাঠামো নির্মাণে একদম খুশি ছিলেন না। আইফেল টাওয়ারের ওপর ঔপন্যাসিক গাই ডি মপসানট এতটাই বিরক্ত ছিলেন যে তিনি প্রায়ই মধ্যাহ্ন ভোজনের জন্য আইফেল টাওয়ারের নিচের রেস্টুরেন্টটিতে খেতে যেতেন। তার যুক্তি ছিল এই একটিমাত্র জায়গায় খেতে বসে বিরক্তিকর আইফেল টাওয়ারটি দেখতে হয় না। তবে আইফেল টাওয়ারের ওপর বিরক্ত এমন প্যারিসবাসীদের জন্য একটি স্বস্তির বিষয় ছিল। এটি নির্মিত হয়েছিল কেবল ২০ বছরের জন্য। ২০ বছর পর ভেঙে ফেলার কথা ছিল এটি। কিন্তু ততদিনে বেতার টেলিগ্রামের যুগ শুরু হয়ে যায়। দেখা গেল আইফেল টাওয়ারের ওপর এন্টেনা বসালে বেতার যোগাযোগের কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়। আজও টেলিভিশন এবং রেডিও সম্প্রচারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে আইফেল টাওয়ার আর দিন গড়ানোর সাথে সাথে এটি প্রায় সব প্যারিসবাসীর প্রিয় স্থাপনা হয়ে ওঠে। শুরুর দিনগুলোতে প্যারাসুট ব্যবহারের নানা পরীক্ষার চালানো হয়েছে আইফেল টাওয়ার থেকে।
ফ্রান্সের স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে ওঠা
ফ্রান্স জয় করলেও আইফেল টাওয়ার জয় করতে পারেননি হিটলার
আইফেল টাওয়ারের নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পর গুস্তাভ আইফেল নিজেই ১,৭০০ টি ধাপ বেয়ে ওপরে উঠেছিলেন। তবে কাজটি যে সহজ নয় সেটি বলাই বাহুল্য। পর্যটকদের জন্য সেখানে লিফটের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্যারিসসহ পুরো ফ্রান্স জার্মানির দখলে চলে যায়। হিটলার নিজেই ফ্রান্স পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। তিনি যাতে আইফেল টাওয়ারে উঠতে না পারেন সেজন্য লিফটের কেবল কেটে দেয়া হয়। যুদ্ধকালীন সময়ে দ্রুত লিফট মেরামতও করিয়ে নিতে পারেনি জার্মানরা। প্যারিসের মাটিতে পা রাখালেও আইফেল টাওয়ারে পা রাখা হয়নি হিটলারের। আর এ থেকেই ফ্রান্সের লোকজন বলতে শুরু করে হিটলার প্যারিস জয় করলেও আইফেল টাওয়ার জয় করতে পারেননি, এটি এখন তাদের স্বাধীনতার প্রতীক। প্রতিবছর ৭০ লাখের মত মানুষ আইফেল টাওয়ার পরিদর্শনে যায়। পয়সা খরচ করে বিশ্বের আর কোন স্থাপনা দেখতে এত মানুষ যায় না।