১৮১৯ সালে মাদারীপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন ফরায়েজী আন্দোলনের অগ্নিপুরুষ হাজী শরীয়তউল্লাহর পুত্র মহসিন উদ্দিন আহমদ (দুদু মিয়া)। ফরায়েজি আন্দোলনের নেতা এই দুদু মিয়া ১৮৬২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ইন্তেকাল করেন। আজ এই মহান ব্যক্তির ১৫০ তম মৃত্যুবার্ষিকী।
দুদু মিয়া প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন তার যোগ্য পিতা হাজী শরীয়তুল্লাহর কাছে। মাত্র ১২ বছর বয়সে তাকে মক্কায় পাঠানো হয় জ্ঞানার্জনের জন্য। কলকাতা হয়ে মক্কা যাওয়ার সময় তিনি বারাসাতে বাংলার আরেক মহান বীর তিতুমীরের সঙ্গেও দেখা করেন বলেও ঐতিহাসিক সূত্রগুলোতে উল্লেখ রয়েছে।
মক্কায় তিনি পাঁচ বছর গভীর অধ্যয়নে ব্যয় করেন। মক্কা থেকে বাড়ি ফিরে আসেন ১৮৩৭ খ্রিষ্টাব্দে। ১৮৪০ খ্রিষ্টাব্দে পিতা হাজী শরীয়তুল্লাহর ইন্তেকালের পর ফরায়েজী আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন তিনি।
ব্রিটিশ বিরোধী ফরায়েজী আন্দোলন ইতিহাসে এক অনন্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত। পলাশীর যুদ্ধ মুসলমানদের জন্য চরম দুর্ভোগ ডেকে এনেছিলো। পাশাপাশি মুসলমানদের প্রতি ইংরেজদের নীতি ছিল শক্রুতামূলক। তাই মুসলমানরা শিক্ষা-দীক্ষা ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছিলো। পূর্ববঙ্গের মুসলমানদেরকে কুসংস্কারের অন্ধকার থেকে বের করে আনার জন্য সর্ব প্রথম এগিয়ে আসনে হাজী শরীয়তউল্লাহ। তিনি চেয়ে ছিলেন মুসলমানদের মধ্যে যে সমস্ত কুসংস্কার প্রবেশ করেছে, তা উচ্ছেদ করে তাদের মধ্যে ইসলাম ধর্মের মূল অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে। এ চিন্তা থেকেই তিনি তার সংস্কার আন্দোলনের নাম দেন ফরায়েজী আন্দোলন। কিন্তু হাজী শরিয়তউল্লাহর মৃত্যুর পর অনেকেই ভেবেছিলেন এই আন্দোলন থেমে থাকবেন। আদতে থেমে থাকা তো দুরের কথা সেটিকে আরো বেগবান করে তুললেন তার পুত্র মুহসীন উদ্দিন দুদু মিয়া।
হাজী শরিয়তউল্লাহ্ ফরায়েজী আন্দোলনকে একটি শান্তিপূর্ণ ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন। কিন্তু দুদু মিয়া ছিলেন বিপ্লবী। তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুড়ে তার সংস্কার ও সংগ্রামের কথা প্রচার করতে থাকেন। ফলে দলে দলে মুসলমানগন দুদু মিয়ার অনুসারী হতে থাকে। দুদু মিয়ার ছিল নিজস্ব লাঠিয়াল বাহিনী । জমিদারদের শায়েস্তা করার জন্য তিনি লাঠিয়াল বাহিনী পাঠিয়ে দিতেন। একসময় দুদু মিয়া অত্যাচারী জমিদার ও নীলকরদের আতঙ্ক হিসেবে পরিচিত হন।
১৮৩৮ সালে মক্কা থেকে ফেরার মাত্র এক বছর পর দুদু মিয়ার বিরুদ্ধে পরগৃহ লুণ্ঠনের মিথ্যা অভিযোগ আনা হয়। অভিযোগকারী ছিল জমিদার, নীলকর এবং তাদের মিত্র সরকারি পুলিশ বাহিনী। এদের মুখপাত্র ছিল নীলকর ডানলপ।
কিন্তু তাদের অন্যায় অভিযোগ ফসকে যায়, মুক্তি পান দুদু মিয়া। ১৮৪১ সালে চুচরী নামক এক ব্যক্তিকে খুনের দায়ে দুদু মিয়া ও তার আরও কয়েকজন শিষ্যকে অভিযুক্ত করা হয়।
ঢাকার অতিরিক্ত দায়রা জজের বিচারে দুদু মিয়া মুক্তি পান, কিন্তু তার ২২ শিষ্যকে সাত বছর করে কারাদ- দেওয়া হয়।
১৮৪১ সালে কানাইপুর, ১৮৪২ সালে ফরিদপুরে অত্যাচারী হিন্দু জমিদারদের সঙ্গে দুদু মিয়ার অনুসারীদের বিরোধ তুঙ্গে ওঠে। নীলকর-জমিদারদের পুঞ্জীভূত আক্রোশ দুদু মিয়া অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে মোকাবেলা করেন।
তার বিরুদ্ধে এ সময় তৈরি করা হয় নানা কাল্পনিক অভিযোগ। ১৮৪৬ সালে (বাংলা ১২৫৩ সালের ৩০ ভাদ্র) ডানলপের গোমস্তা, জমিদার গঙ্গাপ্রসাদ চৌধুরী, পাঁচচরের গোপীমোহন বাবু ও জগৎ চন্দ্র বাবুর নেতৃত্বে লাঠিয়াল বাহিনী দুদু মিয়ার বাহাদুরপুরের বাড়ি আক্রমণ করে। এসময় তার বেশ কয়েকজন অনুসারীকে হতাহত করে বাড়ির মুল্যবান গৃহসামগ্রী লুণ্ঠন করে তারা।
প্রতিকার চেয়ে আদালতের দারস্থ হন দুদু মিয়া, কিন্তু স্থানীয় পুলিশ কর্তৃপক্ষের কারসাজিতে ফেঁসে যায় মামলাটি। কিন্তু এই অত্যাচারের প্রতিশোধ গ্রহণে বদ্ধপরিকর হন দুদু মিয়া। কিছু দিনের মধ্যেই কাদির বখশের নেতৃত্বে ডানলপের নীলকুঠি আক্রমণ করে দুদু মিয়ার অনুসারীরা।
ডানলপ পালিয়ে যায়। ধরা পড়ে তার গোমস্তা কাঞ্জীলাল। আদালতে অভিযোগ আনা হয় দুদু মিয়া ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে। দুদু মিয়া ও তার কিছু সংখ্যক হিন্দু ও দেশীয় খৃষ্টান অনুচরসহ মোট ৪৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
ওই মোকদ্দমায় দুদু মিয়া ও তার সব অনুচর বেকসুর খালাস পান। এর পর থেকে দুদু মিয়া ও তার অনুসারীদের প্রভাব প্রতিপত্তি বহুগুণে বেড়ে যায়।
জমিদার-নীলকররা নানা কূট-কৌশলের আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করলেও তারা ব্যর্থ হয়। দীর্ঘ এক দশক দুদু মিয়া ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে তারা আর দাঁড়াতে পারেনি।
তবে ১৮৫৭ সালে আবারও বন্দীত্ব বরণ করতে হয় এই মহান স্বাধীনতা-সংগ্রামীকে। গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে তখন সিপাহী বিদ্রোহের ডামাডোল। জমিদার ও নীলকররা এ সময় সরকারের কান ভারি করে তোল দুদু মিয়া ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে।
তখন সরকার ছিল নাজুক অবস্থায়। ফলে গ্রেফতার করা হয় দুদু মিয়াকে। পরে ১৮৫৯ সালে মুক্তি পেলেও অসৎ জমিদারদের উস্কানিতে আবারও বন্দী হন তিনি।
তার বিরুদ্ধে কোন মামলা না থাকলেও ১৮৬০ সাল পর্যন্ত বন্দি রাখা হয় তাকে। তিনি যখন কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন তখন তার স্বাস্থ্য ভগ্নপ্রায়। মুক্তির অল্পকাল পরেই অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি।
এর পর তাকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। এখানেই ইন্তেকাল করেন তিনি। পুরান ঢাকার ১৩৭ নং বংশাল রোডে কবর দেয়া হয় তাকে। এখানেই চির নিদ্রায় শায়িত আছেন এই মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী।