২৩ শে জুন পলাশী দিবস। আজকাল অনেকটা অলক্ষ্যেই কেটে যায় দিনটি। ১৭৫৭ সালের এ দিনে পলাশীর আমবাগানে এক অসম্ভব যুদ্ধ জিতেছিলেন রবার্ট ক্লাইভ। পৃথিবীর ইতিহাসে, বিশেষ করে উপমহাদেশের ইতিহাসে পলাশীর যুদ্ধ একটি অন্যতম মোড় পরিবর্তনকারী যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। মূলত পলাশীর যুদ্ধে বিজয়ই অন্য ইউরোপীয়দের হটিয়ে ভারতে ইংরেজ আধিপত্য বিস্তারের পথ তৈরি করে দেয়। পলাশীর যুদ্ধে জয়ের খবরে লন্ডনে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শেয়ারের দাম নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায়, কারণ বিনিয়োগকারীরা বুঝতে পারছিলেন বাংলার সম্পদে কোম্পানিটি এখন হৃষ্টপুষ্ট হয়ে উঠবে।
বাংলার ঐশ্বর্যে রবার্ট ক্লাইভ এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তিনি মুর্শিদাবাদকে তাঁর দেশের লন্ডন নগরীর সাথে তুলনা করেছিলেন। ক্লাইভের মতে তফাত ছিল একটাই, মুর্শিদাবাদে একটা ধনিক শ্রেণী রয়েছে।
পটভূমি
সে সময় ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশর বণিকগণ ভারতে আসতো ব্যবসার উদ্দেশ্যে। কিন্তু মোগল শাসকের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে ইংরেজরা কিছু বিশেষ সুবিধা (বাংলায় শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা) পেয়ে ব্যবসায় সমৃদ্ধি লাভ করে। এক পর্যায়ে বাংলায় ইংরেজ এবং ফরাসীদের মধ্যে ব্যবসায়িক বিরোধ তৈরি হয়। বাংলা, বিহার এবং উড়িষ্যার নবাব ছিলেন আলীবর্দি খান। তিনি স্বাধীনভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। ১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল তাঁর মৃত্যুর পর তরুণ সিরাজউদ্দৌলা নবাব হন। এটি নওয়াব পরিবারের অনেকেই মেনে নিতে পারেন নি। পরিবারের এবং প্রশাসনের অনেকের অসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে ইংরেজরা সিরাজউদ্দৌলাকে অপসারণের পথ খুঁজতে থাকে। এক বছরের কিছু বেশি সময় তিনি নবাবী করতে পরেছিলেন।

সিরাজ ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই একযোগে তাঁর সকল প্রতিদ্বন্দ্বী এবং ষড়যন্ত্রকারীদের দমন করতে মনযোগী হন। মুর্শিদাবাদের যে ধনিক গোষ্ঠী সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখছিল নবাব তাদের দমন করে নতুন গোষ্ঠীর উত্থান ঘটানোর চেষ্টা করেন। যখন ইংরেজরা তাঁর নির্দেশ অমান্য করে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ নির্মাণ করে, তখন সিরাজ কলকাতা আক্রমণ করে দখল করে নেন এবং কলকাতার নাম বদলে আলীনগর রাখেন। পরবর্তীতে ইংরেজরা শক্তিবৃদ্ধি করে কলকাতা পুনর্দখলের চেষ্টা করে। এসময় ইংরেজ এবং নবাবের মধ্যে একটি সমঝোতা হলেও ইংরেজরা সেটি মানেনি।
ইংরেজদের সাথে নবাবের সম্পর্ক খারাপ হওয়ার আরও কিছু কারণ ছিল:
-
ইংরেজরা মোগল সম্রাটের দেয়া বাণিজ্যিক সুবিধার অপব্যবহার করতে থাকলে নবাব সেটি বন্ধ করেন এবং ইংরেজ বণিকদের ব্যক্তিগত ব্যবসা বন্ধ করেন।
-
নবাবের প্রচুর ধনসম্পদসহ রাজবল্লভ পুত্র কৃষ্ণদাস ইংরেজদের আশ্রয় নিলে নবাব তাকে ফিরিয়ে দিতে বলেন। কিন্তু ইংরেজরা তা করতে অস্বীকৃতি জানায়।
-
ইংরেজরা নবাবের দূত নারায়ণ সিংহকে অপমান করার খবরে নবাব ক্রুদ্ধ হন।

যুদ্ধ
একটি পর্যায়ে ইংরেজরা নবাবকে উৎখাতের সিদ্ধান্ত নেয় এবং সৈন্যবাহিনী নিয়ে মুর্শিদাবাদের পথে অগ্রসর হয়। সিরাজও তাঁর বাহিনী নিয়ে পলাশীর পথে অগ্রসর হন। ২৩শে জুন সকাল আটটার দিকে যুদ্ধ শুরু হয়। ইংরেজদের বাহিনীর তুলনায় নবাবের বাহিনীর আকার অনেক বড় হলেও মীরজাফর, ইয়ার লতিফ এবং রায় দুর্লভের অধীনস্থ প্রায় দুই তৃতীয়াংশ সৈন্য নিষ্ক্রিয় দাঁড়িয়ে থাকে। মীর মর্দান, মোহনলাল, খাজা আব্দুল হাদী খান, নব সিং হাজারীর নেতৃত্বাধীন সৈন্যরা এবং ফরাসী সৈনিকদের একটি দল যুদ্ধ চালিয়ে যায়। ক্লাইভ যুদ্ধে ধারণার চেয়ে বেশি প্রতিরোধের সম্মুখীন হন। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বৃষ্টিতে নবাব এবং ফরাসীদের কামানের গোলায় ব্যবহৃত গানপাউডার ভিজে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে। কিন্তু ইংরেজরা তাদের গান পাউডার সুরক্ষিত রাখতে সক্ষম হয়। জানা যায়, ক্লাইভ দিনে যুদ্ধ চালিয়ে রাতে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু যুদ্ধের এক পর্যায়ে বেলা তিনটার দিকে কামানের গোলার আঘাতে মীর মর্দান নিহত হলে নবাব ভেঙে পড়েন এবং মীর জাফরের কাছে পরামর্শ চান। মীরজাফর নাবাবকে যুদ্ধ বন্ধ করে পরবর্তী দিনে নতুন উদ্যমে যুদ্ধ করার পরামর্শ দেন।

মোহনলালের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও নবাব যুদ্ধ বন্ধের নির্দেশ দেন। নবাবের সৈন্যরা পিছু হটে আসে। মীরজাফরের বার্তা পেয়ে ইংরেজরা নবাবের অপ্রস্তুত বাহিনীর ওপর হামলা চালায় এবং যুদ্ধে জয়লাভ করে।
শেষকথা
যদিও ইংরেজরা আরও কিছুদিন নবাবী ব্যবস্থা বহাল রাখে, কিন্তু তারা সামরিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ভাবে ইংরেজদের অধীনে ছিলেন। এরপর নবাব মীর কাসিম একটি চেষ্টা চালিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন।
পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের বিজয় কোন সামরিক বিজয় ছিল না। এটি ছিল একটি রাজনৈতিক বিজয়। সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে আট ঘণ্টার এই যুদ্ধকে ‘যুদ্ধ’ না বলে ছোট দাঙ্গার সাথে তুলনা করা যায়। কিন্তু এ যুদ্ধই ভারতে ইংরেজ উপনিবেশের সূচনা করে এবং বাংলা প্রায় ২০০ বছর ইংরেজদের অধীনে থাকে। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন পলাশীর যুদ্ধের ফল বিপরীতটি হলে ইংল্যান্ড নয় বাংলাই বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা করে নিতে পারতো।
প্রাসঙ্গিক লেখা;
গ্রন্থনা: শিহাব উদ্দিন আহমেদ